পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন

সালাফিপিডিয়া থেকে
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অধিকার আদায়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আয়োজিত মিছিল

টেমপ্লেট:বাংলাদেশের ইতিহাস টেমপ্লেট:বাংলাদেশের সংস্কৃতি বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। প্রচলিত স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চর্চার অধিকার হিসেবে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার প্রধান বা প্রাথমিক রাষ্ট্রভাষা এবং পাকিস্তান অধিরাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পূর্ব বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠের গণদাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পাকিস্তান সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রসঙ্গ থেকে এ আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলনের সবচেয়ে সক্রিয় রূপ দেখা যায়। তৎকালীন ও তৎপরবর্তী স্থানীয় রাজনীতিতে এ আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল সুদূরপ্রসারী ছিল।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দুইটি অংশ: পূর্ব বাংলা (১৯৫৫ সালে পুনর্নামাঙ্কিত পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের (প্রায় ১২৪৩ মাইল) অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে ইসলামীকরণ তথা আরবিকরণের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে যে, উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে, পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লিখন অথবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়।[১] এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত বিকাশ লাভ করে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক,[২] সালাম, এম. এ. ক্লাসের ছাত্র বরকতআব্দুল জব্বারসহ[৩][৪] আরও অনেকে নিহত হয়। এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হয়। নিহতদের রক্তে মহাসড়ক রঞ্জিত হয়ে ওঠে। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শোভাযাত্রাসহকারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামক এক কিশোর নিহত হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। উক্ত পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিন পদত্যাগ করে। ভাষা আন্দোলনের নিহতদের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা শহীদ মিনার গড়ে ওঠে, যা ২৪ ফেব্রুয়ারিতে ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রতিবাদ মিছিলে নিহত শফিউর রহমানের পিতা উদ্বোধন করে। ২৬ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করে।

ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলাউর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করে।[৫] ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদ্‌যাপন করা হয়।[৬]

পটভূমি[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

বর্তমানের পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র দুটি পূর্বে ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে উর্দু ভাষাটি কিছু সংখ্যক মুসলিম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ধর্মীয় নেতা স্যার খাজা সলিমুল্লাহ, স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব ওয়াকার-উল-মুলক মৌলভী এবং মৌলভী আবদুল হক প্রমুখদের চেষ্টায় ভারতীয় মুসলমানদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কায় উন্নীত হয়।[৭][৮] উর্দু একটি ইন্দো-আর্য ভাষা, যা ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য। এ ভাষাটি আবার ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। উর্দু ভাষাটি অপভ্রংশের (মধ্যযুগের ইন্দো-আর্য ভাষা পালি-প্রাকৃতের সর্বশেষ ভাষাতাত্ত্বিক অবস্থা) ওপর ফার্সি, আরবি এবং তুর্কির ঘনিষ্ঠ প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে[৯] দিল্লি সুলতানাতমুঘল সাম্রাজ্যের সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বিকশিত হয়।[১০] এর পারসিক-আরবি লিপির কারণে উর্দুকে ভারতীয় মুসলমানদের ইসলামী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হত; যেখানে হিন্দি এবং দেবনাগরী লিপিকে হিন্দুধর্মের উপাদান বিবেচনা করা হত।[৭] বাংলা পূর্বাঞ্চলীয় মধ্য ইন্দো ভাষাসমূহ থেকে উদ্ভূত একটি পূর্বাঞ্চলীয় ইন্দো-আর্য ভাষা,[১১] যা বাংলার নবজাগরণের সময়ে বিপুল বিকাশ লাভ করে।

উর্দুর ব্যবহার উত্তর ভারতের মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে আর বাংলার (ব্রিটিশ ভারতের পূর্বাঞ্চলের একটি প্রদেশ) মুসলমানেরা বাংলা ভাষাকে তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন এবং আধুনিক ভাষা হিসেবে বাংলার বিস্তার তখন থেকে বিকশিত হয়। বাংলা ভাষার সমর্থকরা ভারত ভাগের পূর্বে উর্দুর বিরোধিতা শুরু করেন, যখন ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে বাংলার সংসদ সদস্যগণ উর্দুকে ভারতের মুসলিমদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা মনোনয়নের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন। মুসলিম লীগ ব্রিটিশ ভারতের একটি রাজনৈতিক দল ছিল, যা ভারত বিভাজনের সময় পাকিস্তানকে একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। [১২] ১৯৩৭ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আবার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা প্রস্তাব করে ও বাঙালিদের নেতা শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক তার বিরোধিতা করেন। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম নিশ্চিত হওয়ার পর বিতর্কটি আবার শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের ১৭ই মে তারিখে খলীকুজ্জমান ও জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব প্রদান করেন। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিলেন ডক্টর মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহমুহম্মদ এনামুল হকসহ বেশ ক'জন বুদ্ধিজীবী প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদ জানান৷ ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যার ফলে বাংলায় তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি জানান এবং তার দাবি অগ্রাহ্য হয়। ফলে ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে "সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ" পুনর্গঠিত হয়েছিল৷ এবং ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং বাংলা ভাষা দাবি দিবস ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রলীগ এই কর্মসূচি পালনে বিশিষ্ট ভুমিকা পালন করে।

শেখ মুজিব, শামসুল হক, অলি আহাদসহ ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করলে ঢাকায় ১৩-১৫ মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে পুর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৫ই মার্চ ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিগুলো ছিল-

  1. ভাষার প্রশ্নে গ্রেপ্তার করা সবাইকে মুক্তি প্রদান করা হবে।
  2. পুলিশি অত্যাচারের বিষয়ে তদন্ত করে একটি বিবৃতি প্রদান করা হবে।
  3. বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে।
  4. সংবাদপত্রের উপর হতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে।
  5. আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না।
  6. ২৯ ফেব্রুয়ারি হতে জারিকৃত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করতে হবে।
  7. পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজি উঠে যাবার পর বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে প্রবর্তন করা হবে।
  8. রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন " রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই" এই মর্মে মুখ্যমন্ত্রী ভুল স্বীকার করে বক্তব্য দিবেন।

পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় আসেন৷ ২১ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষণা দেন "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা।" এরপর ২৪ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তার উক্তির চরম প্রতিবাদ জানায়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও একইভাবে প্রতিবাদ জানানো হয়।[১৩]

আন্দোলনের সূচনা[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশশাসিত অঞ্চলগুলো ১৯৪৭ এবং ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে চারটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়: ভারত, বার্মা (বর্তমান মায়ানমার), সিংহল (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) এবং পাকিস্তান (যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানও অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা অধুনা বাংলাদেশ নামে পরিচিত)।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের (পূর্ব বাংলা হিসেবেও পরিচিত) বাংলাভাষী ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ ৬ কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যাবিশিষ্ট নবগঠিত পাকিস্তানের নাগরিকে পরিণত হয়।[৩] কিন্তু পাকিস্তান সরকার, প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল।[১৪] ১৯৪৭ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশসহ প্রচারমাধ্যম ও বিদ্যালয়ে কেবলমাত্র উর্দু ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়।[১৫][১৬] তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। ওই সমাবেশে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের প্রবল দাবি উত্থাপন করা হয়।[১৭] কিন্তু পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাকে তাদের অনুমোদিত বিষয়তালিকা থেকে বাদ দেয় ও সাথে সাথে মুদ্রা এবং ডাকটিকেট থেকেও বাংলা অক্ষর বিলুপ্ত করে। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।[১৮] পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রদের একটি বিশাল সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল এবং সমাবেশের আয়োজন করে।[৩]

নেতৃস্থানীয় বাঙালি পণ্ডিতগণ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে মত দেন। ভাষাবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পাকিস্তানের কোনো অংশেই উর্দু স্থানীয় ভাষা ছিল না বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি পাকিস্তানের ধর্মভাষা হিসেবে উর্দুর পরিবর্তে সরাসরি আরবিকে গুরুত্ব দিয়ে আর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে উর্দুর উপর প্রাধান্য দিয়ে বলেন যে, “আমাদের যদি (বাংলার পর) একটি দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয়, তবে আমরা উর্দুর কথা বিবেচনা করতে পারি।”[১৯] সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ বলেছেন যে, উর্দুকে যদি রাষ্ট্রভাষা করা হয় তবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ ‘নিরক্ষর’ এবং সকল সরকারি পদের ক্ষেত্রেই ‘অনুপযুক্ত’ হয়ে পড়বে।[২০] ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন।[৩][২১] পরবর্তীতে সংসদ সদস্য সামসুল হক আহ্বায়ক হয়ে নতুন কমিটি গঠন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে কার্যক্রম আরও জোরদার করেন।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রস্তাব[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি সদস্যদের বাংলায় বক্তৃতা প্রদান এবং সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং ২৫শে ফেব্রুয়ারি তা গণপরিষদে পেশ করা হয়।[৩][২২]ইংরেজিতে প্রদত্ব বক্তৃতায় বাংলাকে অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে উল্লেখ করে ধীরেন্দ্রনাথ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি তোলেন। এছাড়াও সরকারি কাগজে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান তিনি।

সংসদ সদস্য প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত এবং শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। তারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন এবং তাদের এ সমর্থনের মাধ্যমে মূলত পূর্ব পাকিস্তানের স্বাভাবিক মতামতই প্রতিফলিত হয়েছিল। তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে পরিষদের সকল মুসলমান সদস্য (সবাই মুসলিম লীগের) একযোগে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন যে, “পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ চায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু হোক।”[২৩][২৪] পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এ প্রস্তাবটিকে পাকিস্তানে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা বলে উল্লেখ করেন। উর্দুকে লক্ষ কোটি মুসলমানের ভাষা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেবলমাত্র উর্দুই হতে পারে” । অনেক বিতর্কের পর সংশোধনীটি ভোটে বাতিল হয়ে যায়।[৩][২৫][২৬] সংসদীয় দলের আপত্তির কারণে অনেক বাঙালি মুসলমান সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উত্থাপিত সংশোধনীটিকে সমর্থন করতে পারেননি।[২৭]

ফজলুর রহমানের আরবি হরফে বাংলা প্রকল্প[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

টেমপ্লেট:মূল ১৯৪৭ দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমান আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তনের প্রচারণা চালাতে থাকেন। ১৯৪৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষক সম্মেলনে ফজলুর রহমান ভাষার ইসলামিকরণের স্বার্থে বাংলাকে আরবি লিপিতে লেখার প্রস্তাব করেছিলেন। পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক শিক্ষা দপ্তরের সেক্রেটারি ফজলে আহমদ করিম ফজলী ছিলেন বাংলাতে আরবি অক্ষর প্রবর্তন প্রচেষ্টার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। চট্টগ্রামের জুলফিকার আলী নামক এক মাওলানাকে দিয়ে করিম ফজলী এবং ফজলুর রহমান উভয়ে ‘হুরফুল কোরআন সমিতি' নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করে তার মাধ্যমে আরবি অক্ষর বাংলাতে প্রবর্তনের আন্দোলন গঠনের চেষ্টা করেন। এ সম্পর্কে পূর্ব-বাংলা শিক্ষা বিভাগের প্রাক্তন পরিচালক জনাব আবদুল হাকিম বলেন; "জনৈক বাঙালি উজির সাহেবের নিজের উর্দুজ্ঞান সম্পর্কে ঢাকাতে কিছু কিছু হাস্যোদ্দীপক কিংবদন্তী শ্রুত হয়। ইনি কেন্দ্রের সর্বশক্তিমান উর্দুমহলে বাহবা পেতে চেয়ে বাংলা ভাষাকে “হুরফুল কোরআন” দ্বারা সুশোভিত করবার জন্য তার উদগ্র আকাঙ্খাকে কার্যকরী করতে চেয়েছিলেন। এজন্য বই পুস্তক প্রকাশনার জন্য বার্ষিক ৩৫ হাজার টাকার একটা কেন্দ্রীয় মঞ্জুরিও তিনি পূর্বোক্ত প্রাদেশিক শিক্ষা সেক্রেটারি হাতে দেবার ব্যবস্থা করেন।”[২৮] এর প্রতিক্রিয়ায় মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ জটিলতা বৃদ্ধির আশঙ্কা করে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন, এবং বাংলাকে অপরিবর্তিত অবস্থায় পূর্ব বাংলা রাষ্ট্রভাষা তথা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।[২৯]

প্রথম প্রতিক্রিয়া[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

গণপরিষদের ঘটনার প্রথম প্রতিক্রিয়া শুরু হয় ঢাকায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ ছাত্রদের উদ্যোগে শহরের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে। ২৯ ফেব্রুয়ারি তারিখেও ধর্মঘট ঘোষিত হয় এবং ঐদিন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস ও ধর্মঘট পালন করা হয়। সরকারের প্ররোচনায় পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ করে এবং অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে।[২৩] তমদ্দুন মজলিস ঐসময়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্র-বুদ্ধিজীবিদের এক সমাবেশ ঘটে।[২৪] ঐ সভায় দ্বিতীয়বারের মত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং শামসুল আলম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। এ পরিষদে অন্যান্য সংগঠনের দুই জন করে প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করা হয়।[২৩] সেখান থেকে ছাত্ররা ১১ মার্চ ধর্মঘট আহ্বান করে এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তার সাহসী ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানায়।

১১ মার্চের কর্মসূচী নির্ধারণের জন্য ১০ মার্চ ফজলুল হক হলে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১১ মার্চ ভোরে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্ররা বের হয়ে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণাঙ্গ ধর্মঘট পালিত হয়। সকালে ছাত্রদের একটি দল রমনা ডাকঘরে গেলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। ছাত্রদের আরও একটি দল রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সচিবালয়ের সামনে নবাব আবদুল গণি রোডে পিকেটিংয়ে অংশ নেয়। তারা গণপরিষদ ভবন (ভেঙ্গে পড়া জগন্নাথ হলের মিলনায়তন), প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউস (বর্তমান বাংলা একাডেমী), হাইকোর্ট ও সচিবালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে অফিস বর্জনের জন্যে সবাইকে চাপ দিতে থাকে, ফলে বিভিন্ন স্থানে তাদেরকে পুলিশের লাঠিচার্জের সম্মুখীন হতে হয়। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজল ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদকে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। এ বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকার সেনাবাহিনী তলব করে। পূর্ব পাকিস্তানের জেনারের অফিসার কম্যান্ডিং ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান (পরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি) মেজর পীরজাদার অধীনে একদল পদাতিক সৈন্য নিয়োগ করেন এবং স্বয়ং গণপরিষদে গিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনকে বাবুর্চিখানার মধ্য দিয়ে বের করে আনেন।[৩০] বিকেলে এর প্রতিবাদে সভা অনুষ্ঠিত হলে পুলিশ সভা পণ্ড করে দেয় এবং কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, রওশন আলম, রফিকুল আলম, আব্দুল লতিফ তালুকদার, শাহ্ মোঃ নাসিরুদ্দীন, নুরুল ইসলাম প্রমুখ। ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন নঈমুদ্দিন আহমদ।[২৪]

খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে চুক্তি[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

১১ তারিখের এ ঘটনার পর ১২ থেকে ১৫ মার্চ ধর্মঘট পালন করা হয়। আন্দোলনের তীব্রতার মুখে ১৫ মার্চ খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আবুল কাশেম, কামরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমূখ অংশগ্রহণ করেছিলেন। আলোচনাসাপেক্ষে দুই পক্ষের মধ্যে ৮টি বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে সরকারের এ নমনীয় আচরণের প্রধান কারণ ছিল ১৯ মার্চ জিন্নাহ্‌'র ঢাকা আগমন। তার আসার পূর্বে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও শান্ত করার জন্য নাজিমুদ্দিন চুক্তিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবিটি তখন পর্যন্ত মেনে নেয়া হয়নি। চুক্তিতে আন্দোলনের সময় গ্রেফতারকৃত বন্দিদের মুক্তি, পুলিশের অত্যাচারের নিরপেক্ষ তদন্ত, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম ও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া, সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইত্যাদি বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত ছিল।[২৩]

আলী জিন্নাহ্‌র ঢাকা সফর[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকায় এক ভাষণে ঘোষণা করেন “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”

১৯ মার্চ ১৯৪৮-এ ঢাকায় এসে পৌঁছান পাকিস্তানের স্থপতি ও গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্। ভারত বিভাগের পর এটাই ছিল তার প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফর। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান) এক গণ-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ও সেখানে তিনি ভাষণ দেন। তার ভাষণে তিনি ভাষা আন্দোলনকে পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেন।[৩১][৩২][৩৩][৩৪][৩৫] তিনি বলেন পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক ভাষা নির্ধারিত হবে প্রদেশের অধিবাসীদের ভাষা অনুযায়ী; আর রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন - “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়”।[৩][৩৩][৩৬][৩৭] তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “জনগণের মধ্যে যারা ষড়যন্ত্রকারী রয়েছে, তারা পাকিস্তানের শত্রু এবং তাদের কখনোই ক্ষমা করা হবে না” । জিন্নাহ্‌'র এ মন্তব্যে উপস্থিত ছাত্র-জনতার একাংশ তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা - এ ধরনের উক্তিতে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।[৩২] ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়ে তিনি একই ধরনের বক্তব্য রাখেন।[১৪] তিনি উল্লেখ করেন এ আন্দোলন সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর বহিঃপ্রকাশ এবং অভিযোগ করেন কিছু লোক এর মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে চাচ্ছে। যখন তিনি উর্দুর ব্যাপারে তার অবস্থানের কথা পুনরুল্লেখ করেন, উপস্থিত ছাত্ররা সমস্বরে না, না বলে চিৎকার করে ওঠে।

একই দিনে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল জিন্নাহ্‌'র সাথে সাক্ষাৎ করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়। উক্ত প্রতিনিধি দলে ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাশেম, তাজউদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম এবং নজরুল ইসলাম।[৩] কিন্তু জিন্নাহ্ খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তিকে একপেশে এবং চাপের মুখে সম্পাদিত বলে প্রত্যাখান করেন।[৩৮] অনেক তর্ক-বিতর্ক ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য জিন্নাহ্'র নিকট স্মারকলিপি পেশ করে।[২৭] ২৮ মার্চ জিন্নাহ্ ঢাকা ত্যাগ করেন এবং সেদিন সন্ধ্যায় রেডিওতে দেয়া ভাষণে তার পূর্বেকার অবস্থানের কথাই পুনর্ব্যক্ত করেন।[৩৯] জিন্নাহ্'র ঢাকা ত্যাগের পর ছাত্রলীগ এবং তমুদ্দন মজলিসের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তমুদ্দন মজলিসের আহ্বায়ক শামসুল আলম তার দায়িত্ব মোহাম্মদ তোয়াহা'র কাছে হস্তান্তর করেন।[৩২] পরবর্তীতে তমুদ্দন মজলিস আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার জন্য কমিউনিস্টদের দায়ী করে একটি বিবৃতি প্রদান করে এবং পরে তারা আস্তে আস্তে আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসে।

লিয়াকত আলি খানের ঢাকা সফর[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তিনি এক ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। ঐ সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের তরফ থেকে প্রদত্ত মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হয়, কিন্তু তিনি কোনোরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। ১৭ নভেম্বর তারিখে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এক সভায় আজিজ আহমদ, আবুল কাশেম, শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, তাজউদ্দিন আহমদ প্রমুখ একটি স্মারকলিপি প্রণয়ন করেন এবং সেটি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের কাছে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রেও কোনো সাড়া দেননি।[২৩][৪০]

পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটির প্রস্তাবনা[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

এর কিছুদিন পর, ১৯৪৯ এর ৯ই মার্চ পূর্ব বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা সমস্যার ব্যাপারে একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে মাওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠনকরা হয়, এবং এই বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়।[৪১] ১৯৫০ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে কমিটি তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে; যা ১৯৫৮ সালে প্রকাশ করা হয়। এখানে ভাষা সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে একটি কার্যকর ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়, যেখানে তারা বাংলাকে আরবি অক্ষরের মাধ্যমে লেখার সুপারিশ করেছিলেন।[৪২]

আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

টেমপ্লেট:মূল

মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব

মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বিশ্বাস করতেন যে, বাঙালিরা ইংরেজি শেখার সাথে সাথে উর্দু শিখতে পারে, তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে: "যেদিন আরবি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে, সেদিন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি ন্যায়সঙ্গত হবে।"[৪৩] তাই ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি এ লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান আরবি ভাষা সংঘের সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন, তা থেকে গণ পরিষদে পেশ করার জন্য একটি খসড়া স্মারকলিপি অনুমোদন করেন, যাতে আরবীকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ এবং শহরের বিভিন্ন কেন্দ্র ও মফঃস্বলে 'দরসে কোরান' বা কোরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়।[৪৪][৪৫] ১৯৫০ সালের ১৮ই জানুয়ারি রাজশাহী কলেজের কিছু শিক্ষার্থী আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সভা আহবান করে। [৪৪] ৩ স্টেট ব্যাঙ্কের গভর্নর জাহিদ হোসেন আরবীকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন এবং এই প্রস্তাব তখন সিন্ধু আইন পরিষদের সদস্য এবং সিন্ধু আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর সৈয়দ আকবর শাহ সমর্থন করেন।[৪৪] ১৯৫১ সালের ১ই ফেব্রুয়ারি করাচীতে বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনের অধিবেশনে ইসমাইলী সম্প্রদায়ের নেতা আগা খান বলেন, আরবীকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হলে আরব জাহান, উত্তর আফ্রিকা এবং ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের মধ্যে সাধারণ যোগাযোগ স্থাপিত হবে।[৪৪] আরবী রাষ্ট্রভাষা করার এসকল প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ১০ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৫১ পাকিস্তান বৌদ্ধ লীগের সেক্রেটারী রবীন্দ্রনাথ বর্মী একটি বিবৃতি দিয়ে তাতে আরবীর পরিবর্তে উর্দুর সমর্থন করেন।[৪৪] আরবীকে রাষ্ট্রভাষা করার এসকল প্রস্তাব পাকিস্তানের কোনো অংশে তেমন কোনো সমর্থন লাভ করে নি।[৪৪] তবে বদরুদ্দীন উমরের মতে, এই দাবী ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশের প্রশ্নের সাথে জড়িত থাকায় তা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রভাষা উর্দু এবং বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রবর্তনের দাবীকে কতগুলো মহলে জোরদার করে।[৪৪]

১৯৫২: ভাষা আন্দোলনের পুনর্জাগরণ[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নওয়াবপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) ছাত্রদের মিছিল।

ভাষা আন্দোলনের মতো আবেগিক বিষয়ের পুনরায় জোরালো হবার পেছনে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের ভাষণ প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।[২৭] তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন খাজা নাজিমুদ্দিন ২৫ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন এবং ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন। তিনি মূলত জিন্নাহ্'র কথারই পুনরুক্তি করে বলেন, জিন্নাহর বক্তব্য অনুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।[৩৮] আরবি অক্ষরে বাংলা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও খাজা নাজিমুদ্দিন সরকারি উদ্যোগের উল্লেখ করে বলেন যে, ইতোমধ্যেই সরকারি তত্ত্বাবধানের ২১ টি পরীক্ষামূলক কেন্দ্রে সাফল্যের সাথে আরবি অক্ষরে বাংলা শিক্ষাদান করা হয়েছে এবং এ ধরনের বহু শিক্ষা কেন্দ্র জনসাধারণ কর্তৃক খোলা হয়েছে।[২৮] রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারিত তার ভাষণে তিনি আরো উল্লেখ করেন যে কোনো জাতি দু'টি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনি।[৩৮] নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। সেদিন ছাত্রসহ নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।[২৩] পরে তারা তাদের মিছিল নিয়ে বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমী) দিকে অগ্রসর হয়।[২১] পরদিন ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়।[৩][৪৬] সভায় আরবি হরফে বাংলা লিখনের সরকারি প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করা হয় এবং ৩০ জানুয়ারির সভায় গৃহীত ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেয়া হয়। পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে।[৩৮]

পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে সমবেত হয়। সমাবেশ থেকে আরবি লিপিতে বাংলা লেখার প্রস্তাবের প্রতিবাদ এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানানো হয়। ছাত্ররা তাদের সমাবেশ শেষে এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে।[৪৭]

১৯৫২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী তারিখে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি'র পূর্বে বাঙলা প্রাদেশিক সাংগঠনিক কমিটির সেক্রেটারিয়েট কর্তাকে 'রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন' শীর্ষক একটি দীর্ঘ সার্কুলার (১০ নম্বর) পার্টি'র মধ্যে প্রচার করা হয়। এই সার্কু'লারটিতে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য, লাইন, এবং সাংগঠনিকভাবে করনীয় কর্তব্য বেশ স্পষ্ট ভাবে নির্দেশ করা হয়।[৪৮]

১১ই ফেব্রুয়ারী তারিখে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি'র পূর্ববঙ্গ সাংগঠনিক কমিটির ১০ নম্বর পার্টি' সার্কুলারে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যে নীতি ও লাইন নির্দেশ করা হয় সেই অনযায়ী তাঁরা ২০শে ফেব্রুয়ারী “সর্ব্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহবানে সাড়া দিন, সকল ভাষার সমমর্যাদা ও বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ২১শে ফেব্রুয়ারী সারা প্রদেশ ব্যাপী ধর্মঘট, হরতাল, সভা ও শোভাযাত্রা করুন" শীর্ষক একটি সাইক্লোস্টাইল করা ইশতেহার প্রচার করেন।এই সংক্ষিপ্ত ইশতেহারটিতে যে সব আহ্বান জানানো হয় সেগুলো হলো, “ইংরেজী ভাষাকে আর রাষ্ট্রভাষা রাখা চলবে না ; পাকিস্তানের সকল ভাষার সমমর্যাদা চাই; বাঙ্গালী, পাঞ্জাবী, পাঠান, সিদ্ধী, বেলচি, উর্দুভাষী প্রভৃতি সকল জাতিকেই নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করার ও রাষ্ট্রকার্য পরিচালনার অধিকার দেওয়া চাই; বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা চাই।...বাংলার জন্য আন্দোলন উপরে বিরদ্ধে আন্দোলন নয়। ইংরেজীর বদলে উর্দু, বাংলা-সকল ভাষাকে রাষ্ট্রে সমমর্যাদা দেওয়ার আন্দোলন। ইংরেজ পাক-ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষি জাতিকে পশ্চাদপদ রাখিয়া সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী শোষণ ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখার জন্য একটি ভাষা ইংরেজী ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করিয়াছিল। লীগ সরকারও একই উদ্দেশ্যে এখন পর্যন্ত ইংরেজী ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাল; রাখিয়াছেন এবং একমাত্র উপনকে রাষ্ট্রভাষা করিতে চাহিতেছেন। একটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষি জাতি পশ্চাদপদ থাকিয়া যাইবে এবং ইহার ফলে পাকিস্তানের সামগ্রিক উন্নতিই ব্যাহত হইবে। অতএব পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাকে সমমর্যাদা দান ও রাষ্ট্রভাষা করার দাবীর আন্দোলনে পাকিস্তানের বাঙ্গালী, পাঞ্জাবী, পাঠান, সিদ্ধী, বেলচে, ঊর্দু ভাষী সকল জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে আগাইয়া আসুন।"[৪৯]

২০ ফেব্রুয়ারি সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন হলে সভা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ৯৪ নবাবপুর রোডস্থ আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরিষদের কিছু সদস্য নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার পক্ষে থাকলেও, সবশেষে ১১-৩ ভোটে[৫০] ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।[২৩] ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে একই বিষয় নিয়ে পৃথক পৃথক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় সলিমুল্লাহ হলে ফকির শাহাবুদ্দীনের সভাপতিত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত সভায় নেতৃত্ব দেন আবদুল মোমিন। শাহাবুদ্দিন আহমদের প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে এই সিদ্ধান্তটি জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নেন আবদুল মোমিন এবং শামসুল আলম।[৫১]

২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২: ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রশ্নে পুরাতন কলাভবন প্রাঙ্গণে আমতলায় ঐতিহাসিক ছাত্রসভা।

পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী এ দিন সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকে এবং পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতামতকে বিবেচনা করার আহ্বান জানাতে থাকে। পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিক ঘিরে রাখে। বিভিন্ন অনুষদের ডীন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঐসময় উপস্থিত ছিলেন। বেলা সোয়া এগারটার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়।[৩] কিছু ছাত্র ঐসময়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে দৌঁড়ে চলে গেলেও বাদ-বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। উপাচার্য তখন পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে অনুরোধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেন। কিন্তু ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় কয়েকজনকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার শুরু করলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় ছাত্ররা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে পুনরায় তাদের বিক্ষোভ শুরু করে।

২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২: পুরাতন কলাভবন প্রাঙ্গণ, ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রাক্কালে।

বেলা ২টার দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের বাঁধা দেয়। কিন্তু পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যখন কিছু ছাত্র সিদ্ধান্ত নেয় তারা আইনসভায় গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবে। ছাত্ররা ঐ উদ্দেশ্যে আইনসভার দিকে রওনা করলে বেলা ৩টার দিকে পুলিশ দৌঁড়ে এসে ছাত্রাবাসে গুলিবর্ষণ শুরু করে।[২৭] পুলিশের গুলিবর্ষণে আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন।[২] এছাড়া আব্দুস সালাম, আবুল বরকতসহ আরও অনেকে সেসময় নিহত হন।[৩][৪] ঐদিন অহিউল্লাহ নামের একজন ৮/৯ বছরেরে কিশোরও নিহত হয়।[৩]

ছাত্র হত্যার সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে জনগণ ঘটনাস্থলে আসার উদ্যোগ নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত অফিস, দোকানপাট ও পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রদের শুরু করা আন্দোলন সাথে সাথে জনমানুষের আন্দোলনে রূপ নেয়।[৩৬] রেডিও শিল্পীরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে শিল্পী ধর্মঘট আহ্বান করে এবং রেডিও স্টেশন পূর্বে ধারণকৃত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে থাকে।[৫২]

ঐসময় গণপরিষদে অধিবেশন শুরুর প্রস্তুতি চলছিল। পুলিশের গুলির খবর জানতে পেরে মাওলানা তর্কবাগিশসহ বিরোধী দলীয় বেশ কয়েকজন অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করে বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ান।[৩] গণপরিষদে মনোরঞ্জন ধর, বসন্তকুমার দাস, শামসুদ্দিন আহমেদ এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত-সহ ছোট ছয়জন সদস্য মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে হাসপাতালে আহত ছাত্রদের দেখতে যাবার জন্যে অনুরোধ করেন এবং শোক প্রদর্শনের লক্ষ্যে অধিবেশন স্থগিত করার কথা বলেন।[২৭] কোষাগার বিভাগের মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ, শরফুদ্দিন আহমেদ, সামশুদ্দিন আহমেদ খন্দকার এবং মসলেউদ্দিন আহমেদ এই কার্যক্রমে সমর্থন দিয়েছিলেন। যদিও নুরুল আমিন অন্যান্য নেতাদের অনুরোধ রাখেননি এবং অধিবেশনে বাংলা ভাষার বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন।[৩][২৭]

ঐ দিনই পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ববঙ্গ সংগঠনী কমিটি "অত্যাচারী নুরুল আমীন সরকারের বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সারা পূর্বে বঙ্গব্যাপী তুমদল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়িয়া তুলন" শীর্ষক একটি সাইক্লোস্টাইল করা ইশতেহার প্রচার করে, যাতে দলমত নির্বিশেষে সকল প্রতিষ্ঠান ও পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষা ভাষী জনসাধারণকে নিম্নলিখিত দাবিতে সমর্থন দানের আহবান জানানো হয়ঃ

  • নাজিম নূরুল আমীন সরকার গদী ছাড়ো
  • অবিলম্বে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা চাই
  • হত্যাকারীর শাস্তি চাই, বেসরকারী তদন্ত কমিশন চাই, হত ও আহতদের জন্য পুরা ক্ষতিপূরণ চাই।
  • অবিলম্বে সকল রাজনৈতিক বন্দীর মক্তি চাই,
  • নিরাপত্তা আইন, ১৪৪ ধারা ও সমস্ত দমনমূলক আইনের প্রত্যাহার চাই।[৫৩]

২২ ফেব্রুয়ারির ঘটনা[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে বিশাল মিছিল বের হয়।

সেদিন আইন পরিষদে বিরোধী দলের সদস্যরা বিষয়টি উত্থাপন করেন। তারা প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনকে হাসপাতালে আহত ছাত্রদের দেখতে এবং অধিবেশন মুলতবি করার ঘোষণা দিতে আহ্বান জানান। ক্ষমতাসীন দলের কিছু সদস্যও এই আহ্বানে সমর্থন জানান। কিন্তু নুরুল আমিন তাদের আহ্বানের সাড়া না দিয়ে অধিবেশন অব্যাহত রাখেন এবং হাসপাতালে যেতে অস্বীকৃতি জানান।

ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে সারা দেশ হয়ে উঠে মিছিল ও বিক্ষোভে উত্তাল। জনগণ ১৪৪ ধারা অমান্য করার পাশাপাশি শোক পালন করতে থাকে।[২৭] বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থল ত্যাগ করে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেয়। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শহরের নাগরিক সমাজ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাস পরিদর্শন করেন। পরে তাদের অংশগ্রহণে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে বিশাল মিছিলে অংশগ্রহণ করে। বেলা ১১টার দিকে ৩০ হাজার লোকের একটি মিছিল কার্জন হলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে এবং একপর্যায়ে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। ঐ ঘটনায় সরকারি হিসেবে ৪ জনের মৃত্যু হয়।

শহরের বিভিন্ন অংশে একইভাবে জানাজা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন কলেজ, ব্যাংক-সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে লোকজন এই মিছিলে অংশ নিতে আসে।[৩৬] বিকেলে আরেকটি বিশাল মিছিল পুলিশ দ্বারা আক্রান্ত হয়। বিক্ষুদ্ধ জনতা সরকার পক্ষের প্রথম সারির দুটি সংবাদপত্র জুবিলী প্রেস এবং মর্নিং নিউজ অফিসে অগ্নিসংযোগ করে।[৫৪][৫৫] উল্লেখ্য, জুবিলী প্রেস থেকে সকালের পত্রিকা বের হয়েছিল।

একই দিনে পুলিশ দ্বারা আক্রমণ ও হত্যার বিভিন্ন ঘটনা ঘটে। নবাবপুর রোডের বিশাল জানাজার মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণ করে। এই গুলিবর্ষণে নিহত হন ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান, ওয়াহিদুল্লাহ এবং আবদুল আউয়াল[২৩] একই রাস্তায় অহিউল্লাহ নামে নয় বছরের এক বালকের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।[৩][৫৬] জনশ্রুতি আছে, পুলিশ কিছু লাশ কৌশলে সরিয়ে ফেলে।

পরবর্তী ঘটনা (১৯৫২)[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর সরকার আন্দোলনের বিপক্ষে জোরালো অপপ্রচার চালাতে থাকে। তারা জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকে যে, কমিউনিস্ট ও পাকিস্তানবিরোধীদের প্ররোচনায় ছাত্ররা পুলিশকে আক্রমণ করেছিল। তারা বিভিন্নভাবে তাদের এই প্রচার অব্যাহত রাখে। তারা সারাদেশে প্রচারণাপত্র বিলি করে। সংবাদপত্রগুলোকে তাদের ইচ্ছানুসারে সংবাদ পরিবেশনে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।[৫৭] পাশাপাশি ব্যাপক হারে সাধারণ জনগণ ও ছাত্র গ্রেফতার অব্যাহত রাখে। ২৫ ফেব্রুয়ারি আবুল বরকতের ভাই একটি হত্যা মামলা দায়ের করার চেষ্টা করলে, উপযুক্ত কাগজের অভাব দেখিয়ে সরকার মামলাটি গ্রহণ করেনি।[৫৮] রফিকউদ্দিন আহমদের পরিবার একই ধরনের একটি প্রচেষ্টা নিলে, ঐ একই কারণে তাও বাতিল হয়। ৮ এপ্রিল সরকার তদন্ত শুরু করে। কিন্তু এর প্রতিবেদনে মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রদের উপর গুলি করার কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ দেখাতে পারেনি।[৫৯] সরকারের প্রতিশ্রুত প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ প্রত্যাখান করে। ১৪ এপ্রিল গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হলে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন সামনে চলে আসে।[৬০] এ সমস্যা নিরসনের পক্ষে অনেক সদস্য মত প্রকাশ করলেও মুসলিম লীগের সদস্যরা এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করেন। এ বিষয়ের বিপক্ষে তারা ভোট দিলে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। এর মাধ্যমে তারা ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর গণপরিষদে বাংলা ভাষার পক্ষে কথা বলার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন।[৬১] ২৭ এপ্রিল বার সেমিনার হলে কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় কর্মপরিষদ একটি সেমিনার আহ্বান করে এবং সরকারের কাছে ২১-দফা দাবি উত্থাপন করে। ১৬ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুললে সেদিন ছাত্ররা সমাবেশ করে। বিশ্ববিদ্যালয় লীগ কমিটির প্রধান নেতা আব্দুল মতিন গ্রেফতার হলে কমিটি আবার পুণর্গঠিত হয়।

শহীদ মিনার[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

টেমপ্লেট:মূল নিবন্ধ

আবুল বরকতের পরিবার শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু করে। কাজ শেষ হয় ২৪ তারিখ ভোরে। তাতে একটি হাতে লেখা কাগজ গেঁথে দেয়া হয়, যাতে লেখা ছিল শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ[৬২] ঐ দিনই শহীদ মিনার নির্মাণের খবর দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে পাঠানো হয়। শহীদ বীরের স্মৃতিতে - এই শিরোনামে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ছাপা হয় শহীদ মিনারের খবর।[২৪]

মিনারটি তৈরি হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হোস্টেলের (ব্যারাক) বার নম্বর শেডের পূর্ব প্রান্তে। কোণাকুণিভাবে হোস্টেলের মধ্যবর্তী রাস্তার গা-ঘেষে। উদ্দেশ্য ছিল যাতে বাইরের রাস্তা থেকে সহজেই দেখা যায় এবং যেকোনো ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে ভেতরের লম্বা টানা রাস্তাতে দাঁড়ালেই যেন চোখে পড়ে। শহীদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উচু আর ৬ ফুট চওড়া। মিনার তৈরির তদারকিতে ছিলেন জিএস শরফুদ্দিন (ইঞ্জিনিয়ার শরফুদ্দিন নামে পরিচিত), নকশা অঙ্কন করেছিলেন বদিউল আলম। তাদের সাথে ছিলেন সাঈদ হায়দার। শহীদ মিনার নির্মাণে সহযোগিতা করেন দুইজন রাজমিস্ত্রী। মেডিক্যাল কলেজের সম্প্রসারণের জন্য জমিয়ে রাখা ইট, বালু এবং পুরনো ঢাকার পিয়ারু সর্দারের গুদাম থেকে সিমেন্ট আনা হয়। ভোর হবার পর একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় মিনারটি।[২৪] ঐ দিনই অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে, ২২ ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলনে নিহত শফিউরের পিতা অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন।[৪০] ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দশটার দিকে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন[২৪] উদ্বোধনের দিন অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী মেডিক্যালের ছাত্রদের আবাসিক হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে।[২৪][৬৩] এরপর ঢাকা কলেজেও একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হয়,[৪০] এটিও একসময় সরকারের নির্দেশে ভেঙে ফেলা হয়।

অবশেষে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেবার পরে ১৯৫৭ সালে সরকারিভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির তত্ত্বাবধানে ১৯৬৩ সালে শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শেষ হয়।[৪০] এবং ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে নিহত বরকতের মা উক্ত মিনারটি উদ্বোধন করেন।[৬৪]

ফেব্রুয়ারি ২৫ তারিখে, কল-কারখানার শ্রমিকরা নারায়ণগঞ্জ শহরে ধর্মঘটের ডাক দেয়।[৬২] ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখে প্রতিবাদে অংশগ্রহকারীরা ব্যাপক পুলিশী হামলার শিকার হন।[৬৫]

একুশের গান[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

টেমপ্লেট:মূল নিবন্ধ

২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের ঘটনার পর ‘একুশ’ নিয়ে প্রথম গান আবদুল গাফফার চৌধুরী;- গানটি হল - আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি। এ গানটিতে প্রথমে সুরারোপ করেন আব্দুল লতিফ। পরে করাচী থেকে ঢাকা ফিরে ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ আবার নতুন করে সুরারোপ করেন।[৬৬] সেই থেকে ওটা হয়ে গেল একুশের প্রভাতফেরীর গান। বর্তমানে আলতাফ মাহমুদের সুর করা গানটিই গাওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে প্রকাশিত হয় গানটি। তৎকালীন সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে। জহির রায়হান তার জীবন থেকে নেয়া ছবিতে এ গানটি ব্যবহার করার পর এর জনপ্রিয়তা ব্যাপকতা লাভ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই গানটির সুনাম আরো বাড়তে শুরু করে। ইতোমধ্যে গানটি সুইডিশ ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।[৬৭] বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে।

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩–৫৬)[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি: প্রথম শহীদ দিবস সকালে ছাত্র-জনতার শোক শোভাযাত্রা মেডিক্যাল হোস্টেল মোড়ে (যেখান থেকে গুলি চলেছিল) নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় মোনাজাত করছে।
১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরিতে ফ্যাস্টুন হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা।

কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় কর্মপরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি স্মরণে শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও দিবসটি পালনে সম্মত হন।[৬৮] ১৯৫৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের উদ্দেশ্যে প্রশাসনের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভাষা আন্দোলনের এক বছর পূর্তিতে সারা দেশব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ দিবস পালিত হয়। অধিকাংশ অফিস, ব্যাংক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষ প্রভাতফেরীতে যোগ দেন। হাজার হাজার মানুষ শোকের প্রতীক কালো ব্যাজ ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আসে এবং মিছিল করে প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে। সহিংসতা রোধের জন্য স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়। প্রায় লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে আরমানিটোলায় বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে এক-দফা দাবি জানানো হয়, ভাষার দাবির পাশাপাশি মাওলানা ভাসানীসহ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি উত্থাপন করা হয়।[৩] রেলওয়ের কর্মচারীরা ছাত্রদের দাবির সাথে একমত হয়ে ধর্মঘট পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাসের ছাত্ররা নিহতদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে।[৬৯] অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ফজলুর রহমান বলেন যে, বাংলাকে যারা রাষ্ট্রভাষা করতে চায় তারা দেশদ্রোহী। তার এ বক্তব্যে জনগণ হতাশ হয়ে তাকে কালো ব্যাজ দেখায়। সাধারণ মানুষের মাঝে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই লেখা সংবলিত স্মারক ব্যাজ বিলি করা হয়। ভাষা সংগ্রাম কমিটি দিবসটি পালন উপলক্ষে সমাবেশ আহ্বান করে। আন্দোলনকে আরো বেগবান করার জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে বিশেষ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ভাষা আন্দোলনের মূল অনুপ্রেরণাদায়ী অমর সঙ্গীত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো... ঐ বছর কবিতা আকারে লিফলেটে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাদে কালো পতাকা উত্তোলনের সময় পুলিশ কিছু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে।[৭০]

যুক্তফ্রন্ট গঠন[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

১৯৫৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের উদ্দেশ্যে প্রভাতফেরিতে নগ্ন পায়ে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান

১৯৫৪ সালকে পূর্ব বঙ্গের রাজনৈতিক ও ভাষা আন্দোলনের ব্যাপক পট পরিবর্তনের বছর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট এবং আওয়ামী লীগ বৃহত্তর প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রস্তাবে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নিন্দা জানায়। নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্ট যেন আন্দোলনের আর কোনো সুযোগ না পায় সেজন্য মুসলিম লীগ তাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখে।[৭১] সেজন্য তারা ভাষা আন্দোলন দিবসের আগে যুক্তফ্রন্টের একাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে।[৭২] অন্যদিকে ভাষা সংক্রান্ত বিষয়ের অচলাবস্থা নিরসনের উদ্দেশ্যে মুসলিম লীগের সংসদীয় কমিটির একটি সভা করাচীতে অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, বাংলা ভাষাকে উর্দু ভাষার সমমর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা করে হবে।[৭৩] এ সিদ্ধান্তের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বকারীরা সেখানকার বিভিন্ন প্রদেশের ছয়টি ভাষাকে একই মর্যাদা দেয়ার দাবি তোলে।[৭৪] আবদুল হক (“বাবা উর্দু” নামে পরিচিত) এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান এবং তার এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অনড় থাকেন। তার নেতৃত্বে ২২ এপ্রিল করাচীতে এক বিশাল প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করা হয়। প্রায় ১ লক্ষ মানুষ মিছিলে অংশ নেয় ও মুসলিম লীগের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়।[৭৫][৭৬] সেখানে সহিংস ঘটনায় সিন্ধি ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক আল ওয়াহিদ পত্রিকার অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়।[৭৭] অন্যদিকে ২৭ এপ্রিল বাংলা ও অন্যান্য ভাষাকে সমমর্যাদা দেয়ার দাবিতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তারা সংখ্যালঘু উর্দুভাষী যারা এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছিল তাদের মানসিকতার তীব্র সমালোচনা করেন। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যায়। গণপরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট এবার অধিকাংশ আসনে জয়লাভ করে; যেখানে মুসলিম লীগের আসনসংখ্যা অত্যন্ত কম ছিল।[৩৬][৭৬]

যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে বাংলা একাডেমী গঠন করে। এ প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, গবেষণা এবং মান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করবে বলে গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করা হয়।[৭৮] যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মালিক গোলাম মাহমুদ ১৯৫৪ সালের ৩০ মে তারিখে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকার বাতিল ঘোষণা করে।[৭২] ১৯৫৫ সালের ৬ জুন তারিখে যুক্তফ্রন্ট পুণর্গঠন করা হয়; তবে আওয়ামী লীগ মন্ত্রীপরিষদে যোগ দেয়নি।[৭১]

১৯৫৬ সালে প্রথমবারের মতো সরকারের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। শহীদ মিনার নতুনভাবে তৈরি করার লক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষা আন্দোলনের নিহতদের স্মরণে পাকিস্তানের গণপরিষদে কার্যক্রম পাঁচ মিনিট বন্ধ রাখা হয়। সারাদেশব্যাপী শহীদ দিবস পালিত হয় এবং বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল।[৭১] আরমানীটোলায় মাওলানা ভাসানী এক বিশাল সমাবেশের নেতৃত্ব দেন।[৭১][৭৯][৮০]

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার সাংবিধানিক স্বীকৃতি[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

১৯৫৪ সালের ৭ মে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়।[৭৬][৮১] ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়।[৭১] সংবিধানের ২১৪(১) অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয়: টেমপ্লেট:উক্তি যদিও আইয়ুব খানের প্রতিষ্ঠিত সামরিক সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিল; ১৯৫৯ সালের ৬ জানুয়ারি সামরিক শাসকগোষ্ঠী এক সরকারি বিবৃতি জারি করে এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানে উল্লেখিত দুই রাষ্ট্র ভাষার উপর সরকারি অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে।[৮২]

সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার; ভাষা আন্দোলনে নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাশে নির্মিত

বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে বাংলা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব বিদ্যমান। বাঙালির মধ্যে বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপলক্ষ উদ্‌যাপন ও ভাষার উন্নয়নের কাজ করার মানসিকতা তৈরিতে এ আন্দোলনের যথেষ্ট ভূমিকা আছে। বাংলাদেশে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘মাতৃভাষা দিবস’ বা ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে, এবং একই সাথে একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। এছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসটি আরো নানাভাবে উদযাপিত হয় যার মধ্যে আছে, মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্‌যাপন, যা একুশে বইমেলা নামে সমধিক পরিচিত। এছাড়াও ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগকারীদের ত্যাগের সম্মানে এ মাসেই ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাষ্ট্রীয় বেসামরিক পদক ‘একুশে পদক’।[৮৩] মানুষের ভেতর একুশের আবেগ পৌঁছে দিতে একুশের ঘটনা ও চেতনা নিয়ে রচিত হয়েছে বিভিন্ন প্রকার দেশাত্মবোধক গান, নাটক, কবিতা ও চলচ্চিত্র। তন্মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ও আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি।[৮৪] ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব সূচিত হয়ে আসছে। রচনাগুলোর মধ্যে আছে - বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী রচিত নাটক কবর; কবি শামসুর রাহমান রচিত কবিতা বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা এবং ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯; জহির রায়হান রচিত উপন্যাস একুশে ফেব্রুয়ারি; বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান রচিত আর্তনাদ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে জহির রায়হান পরিচালিত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া[৪০]

প্রথম শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলার ২বছর পর ১৯৫৪ সালে নিহতদের স্মরণে নতুন একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। ১৯৫৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সহযোগিতায় বড় পরিসরে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু করা হয়। নতুন শহীদ মিনারের স্থপতি ছিলেন হামিদুর রহমান এবং নভেরা আহমেদ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল চত্বরে বড় আকারের এই স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়। মূল বেদির উপর অর্ধ-বৃত্তাকারে সাজানো ৫টি স্তম্ভের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে, মা তার ভাষা আন্দোলনে নিহত সন্তানদের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের কারণে স্থাপনাটির নির্মাণ কাজের অগ্রগতি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আবুল বরকতের মা হাসনা বেগম শহীদ মিনারটির উদ্বোধন করেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী এটি ভেঙ্গে দেয়। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার এটি পুনরায় নির্মাণ করে।[৮৫]

আন্দোলনের পর আওয়ামী মুসলিম লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে শুরু করে এবং দলের নাম থেকে “মুসলিম” শব্দটি বাদ দিয়ে দেয়।[৮৬]

কোলকাতা ভাষা শহীদ মিনার

পূর্ব পাকিস্তান ছাড়াও ভারতের আসম রাজ্যে বাংলা ভাষাকে সমমর্যাদা দেয়ার লক্ষ্যে আন্দোলন হয়েছিল। ১৯৬১ সালের ১৯ মে শিলচর রেলস্টেশনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য দাবি জানালে পুলিশের গুলিতে ১১ বাঙালি নিহত হন। পরবর্তীতে আসামের বাংলাভাষী লোকসংখ্যা বেশি রয়েছে এমন ৩টি জেলাতে বাংলাকে আধা-সরকারি ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে।[৮৭]

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

টেমপ্লেট:মূল নিবন্ধ ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার ইউনেস্কোর কাছে লিখিতভাবে প্রস্তাব করে, যা ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর সংস্থার ৩০তম সাধারণ অধিবেশনে নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়ে পাশ হয়।[৮৮]

বাংলাদেশের স্বাধীনতা[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

টেমপ্লেট:মূল নিবন্ধ যদিও ১৯৫৬ সালের পর সরকারি ভাষার বিতর্ক সম্পন্ন হয়, কিন্তু আইয়ুব খানের সামরিক শাসন পাকিস্তানের পাঞ্জাবি ও পশতুনদের দেনাগুলো বাঙালিদের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়। জনসংখ্যার দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সামরিক এবং বেসামরিক চাকুরীর ক্ষেত্রে বাঙালিদের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব এবং সরকারি সাহায্যের দিক থেকেও বাঙালিদের প্রাপ্ত অংশ ছিল খুবই কম। জাতিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে বাঙালিদের এ বৈষম্যের ফলে চাপা ক্ষোভের জন্ম নিতে থাকে। এরই প্রভাব হিসেবে আঞ্চলিক স্বার্থসংরক্ষণকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের সমর্থন নিরঙ্কুশভাবে বাড়তে থাকে।[৩৩] এর ফলেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আরো বড় অধিকার আদায় ও গণতন্ত্রের দাবিতে ছয় দফা আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনই পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আকার ধারণ করে।[৮][১৪]

পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিক্রিয়া[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

ভাষা আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত অমর একুশে ভাস্কর্য।

যদিও পূর্ব পাকিস্তানের অনেক বাঙালি মনে করেন যে, বাংলা ভাষা আন্দোলন জাতিগত জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে সংঘটিত হয়েছিল; কিন্তু এ আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশের সংস্কৃতির পার্থক্যগুলো সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে।[৮][৩৩][৮৯] পশ্চিম পাকিস্তানে এ আন্দোলনটি পাকিস্তানি জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে বিভাগীয় উত্থান বলে মনে করা হয়।[৯০] দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে “একমাত্র উর্দু” নীতি প্রত্যাখ্যান করাকে মুসলমানদের পারসিক-আরবি সংস্কৃতি এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার মূল মতাদর্শের গুরুতর লঙ্ঘন হিসাবে দেখা হয়।[৮] পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন শক্তিশালী রাজনীতিবিদ মনে করেন যে, “উর্দু” হল ভারতীয় ইসলামী সংস্কৃতির অংশ, আর বাংলাকে তারা হিন্দু সংস্কৃতির সংমিশ্রণে তৈরি বাংলা সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচনা করতেন।[১৪] অধিকাংশই যারা “একমাত্র উর্দু” নীতির পক্ষে ছিলেন, তারা মনে করতেন যে, উর্দু কেবলমাত্র পাকিস্তান দেশের ভাষা হিসেবেই নয়, বরং সমগ্র জাতির ভাষা হিসেবে উর্দুকে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এধরনের চিন্তা-ভাবনাও উর্দু নীতির বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল; কেননা, পাকিস্তানে তখন আরও বেশ কিছু ভাষাগত পার্থক্যের সম্প্রদায় ছিল।[১৪] ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে আইয়ুব খান বলেন যে, “পূর্ব পাকিস্তান... এখনো হিন্দু সংস্কৃতি এবং প্রভাবের অধীনে রয়েছে।”[১৪]

ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতিগত জাতীয়তাবাদীভিত্তিক দলগুলোর কার্যক্রমে গতির সঞ্চার করে।[৮] পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, কেন্দ্রীয় সরকার এবং যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বে প্রদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল ১৯৫৮ সালে সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুব খানের সামরিক অভ্যূত্থানের অন্যতম প্রধান কারণ।[৩৬]

গণমাধ্যমে বাংলা ভাষা আন্দোলন[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিতর্কের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। সংবাদপত্রগুলো বাংলার পক্ষে-বিপক্ষে নানা প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও সংবাদ প্রকাশ করে ভাষার ইস্যুটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।

কলকাতা থেকে মুসলিম লীগের সমর্থক পত্রিকাগুলোতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ প্রসঙ্গে বেশ কিছু প্রবন্ধ ছাপা হয়। দৈনিক ইত্তেহাদ বাংলা ভাষার পক্ষে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছিল। দৈনিক আজাদও ভুমিকা রেখেছিল৷ তারা বাংলা ভাষার সমর্থনে বেশ কিছু প্রবন্ধ ছাপায়।

দেশভাগের আগে দৈনিক আজাদ ভাষার প্রশ্নে করা বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশ করে। তবে এ ব্যাপারে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতি শুরু থেকে নিরপেক্ষ ছিল। আজাদে কখনো বাংলা ভাষার পক্ষে আবার কখনো বিপক্ষে বক্তব্য প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত ভাষার প্রশ্নে পত্রিকাটির কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান ছিল না।

১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু?’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এই পুস্তিকায় দৈনিক ইত্তেহাদের সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদের প্রবন্ধও ছিল।

শুরু থেকেই মর্নিং নিউজ বাংলা ভাষার তীব্র বিরোধিতা করে আসছিল। এই পত্রিকা ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করে এবং ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় ও খবর প্রকাশ করত।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাংলা ভাষার প্রতি পাকিস্তানের একচোখা নীতি বিষয়ে তমদ্দুন মজলিসের কয়জন নেতা মন্ত্রী ফজলুর রহমানের সাথে আলোচনা করেন, কিন্তু মন্ত্রী বিষয়টিকে ' অনিচ্ছাকৃত ভুল’ বলে বক্তব্য করেন। ইত্তেহাদ পত্রিকা তাঁর এই বক্তব্যের ওপর ‘ভুলের পুনরাবৃত্তি’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি তোলেন। ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি অমৃত বাজার পত্রিকা এই খবর প্রকাশ করে ৷

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণপরিষদে খাজা নাজিমুদ্দিন বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীর মনোভাব রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে। ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক আজাদ তাঁর এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এই সম্পাদকীয়র বক্তব্যটি বাংলা ভাষার পক্ষে পত্রিকাটির জোরালো সমর্থন নির্দেশ করে। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের সময় পত্রিকাটি সর্বতোভাবে উর্দুকেই সমর্থন করে তাও একই বছরে৷

কিছু পত্রিকা বাংলা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে গঠিত সংগ্রাম পরিষদে ‘ইনসাফ’, ‘জিন্দেগী’ ও ‘দেশের দাবী’ পত্রিকা থেকে তিনজন করে প্রতিনিধি নেওয়া হয়।

১৯৪৮ সালের পর বাংলা ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এসময় পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের চেষ্টা করে। দৈনিক আজাদে বিষয়টি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের খবর ১৯৫০ সালের ২৪ মে'তে বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ছাত্রছাত্রীতে পূর্ণ হয়ে যায়। তৎকালীন আমতলায় সভা বসেছিল। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক চলে। একপর্যায়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা আসে। ‘১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান ওঠে, এবং আন্দোলন শুরু হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশ গুলি চালায় এবং অনেকে নিহত হন।

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের ঘটনার পর ভাষার প্রশ্নে দৈনিক আজাদ ভাষা আন্দোলনের পক্ষ নেয়। ঐদিন সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদ বিশেষ টেলিগ্রাম প্রকাশ করে যাতে ‘ছাত্রদের তাজা খুনে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’ ব্যানার শিরোনাম করা হয়। পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রাদেশিক পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। ঘটনার প্রতিক্রিয়া নিয়ে পরবর্তী কয়েক দিন দৈনিক আজাদ প্রচুর সংবাদ ছাপে।

সেসময় মর্নিং নিউজ পত্রিকাটি উর্দু ভাষার সমর্থক ছিল, পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় পাকিস্তান সরকারের পক্ষ নিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি খবর প্রকাশ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ জনতা ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে অবস্থিত মর্নিং নিউজের প্রেস ও অফিস জ্বালিয়ে দেয়।[৯১]

উদ্‌যাপন[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

ভাষা আন্দোলনে নিহতেদর স্মরণে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে স্থাপিত মোদের গরব ভাস্কর্য

১৯৫৩ সাল থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে বাংলায় ভাষা আন্দোলনের নিহতদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ দিন প্রত্যুষে সর্বস্তরের মানুষ খালি পায়ে প্রভাতফেরীতে অংশগ্রহণ করে এবং শহীদ মিনারে গিয়ে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। সারাদিন মানুষ শোকের চিহ্নস্বরূপ কালো ব্যাজ ধারণ করে। এছাড়া আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি তর্পণ করা হয় এবং ভাষা আন্দোলনের নিহতদের শহীদ আখ্যায়িত করে তাঁদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করা হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দিনটি কখনো জাতীয় শোক দিবস, কখনোবা জাতীয় শহীদ দিবস হিসাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। ২০০১ সাল থেকে দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে উদযাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এদিনে সরকারি ছুটি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরা হয়। দৈনিক সংবাদপত্রসমূহে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়। পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলা ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একুশে পদক প্রদান করে।

সমালোচনা[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

যদিও বাংলা ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলা এবং পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের অনেক বাঙালির জন্য জাতি-জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপন করেছে বলে মনে করা হয়, কিন্তু এটি পাকিস্তানের দুই শাখার কর্তৃপক্ষের মধ্যে সাংস্কৃতিক বৈরিতাও বাড়িয়ে দেয়।[৯২] পাকিস্তানের পশ্চিম শাখা ভাষাগত আন্দোলনকে সমাজের কিছু অংশের বিদ্রোহ ছাড়া আর কিছুই মনে করে নি।[৯৩] কিছু সমালোচকের কাছে, পাকিস্তানের উর্দু নীতির প্রতি আপত্তি ছিল মুসলমানদের ফার্সি আরব সংস্কৃতির প্রতি আপত্তির সাথে সাথে "দুটি রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান" এ মতাদর্শ এবং একটি নতুন চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠার আপত্তির সমতুল্য। এছাড়াও, পশ্চিম শাখার কিছু রাজনৈতিক প্রভাব উর্দু ভাষাকে ইসলামী ভারতীয় সংস্কৃতির একটি পণ্য হিসাবে দেখে, এবং বলে বাংলা ভাষা হিন্দুধর্মের অংশ, এবং তাদের অধিকাংশই পক্ষ নেয় পশ্চিম অংশের সাথে এবং বিশ্বাস করে যে উর্দুই দেশের একমাত্র আদিবাসী ভাষা, এবং এই বিশ্বাসটি পাকিস্তান এর পশ্চিম অংশে যেখানে অন্যান্য ভাষা গোষ্ঠী রয়েছে সেখানে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করে। ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বলেছিলেন যে পূর্ববঙ্গ এখনও হিন্দু প্রভাব ও সংস্কৃতির অধীনে রয়েছে। বাংলা ভাষা আন্দোলনের পর মুসলিম আওয়ামী লীগ দলটি বাঙ্গালী জাতীয় আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয় এবং "মুসলিম" শব্দটি মুছে ফেলা হয়।[৯৪] ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানি জনগণকে পাকিস্তান এর পশ্চিম শাখার প্রতি তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং অনেক জাতিগত জাতীয়তাবাদী দল আবির্ভূত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক সরকারের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল প্রধান কারণগুলির মধ্যে একটি, যা আইয়ুব খান-এর নীতির বিরুদ্ধে ১৯৫৮ সালের অভ্যুত্থানের দিকে পরিচালিত করেছিল।[৯৫]

আরও দেখুন[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

আরও পড়ুন[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

  • আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ঢাকা, ১৯৭৫।
  • আবদুল হক, ভাষা-আন্দোলনের আদি পর্ব, ঢাকা, ১৯৭৬।
  • বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ১ম, ২য় ও ৩য় খন্ড, ঢাকা, ১৯৭০-১৯৮৪

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা | উৎস সম্পাদনা]

টেমপ্লেট:Commons category

টেমপ্লেট:বাংলা ভাষা আন্দোলন টেমপ্লেট:বাংলাদেশের স্বাধীনতা টেমপ্লেট:বাংলাদেশ বিষয়াবলী টেমপ্লেট:নির্বাচিত নিবন্ধ

  1. স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  2. ২.০ ২.১ ইতিহাস, কবির উদ্দিন আহমেদ. পৃ-২২৫-২৬
  3. ৩.০০ ৩.০১ ৩.০২ ৩.০৩ ৩.০৪ ৩.০৫ ৩.০৬ ৩.০৭ ৩.০৮ ৩.০৯ ৩.১০ ৩.১১ ৩.১২ ৩.১৩ ৩.১৪ ৩.১৫ উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; ref-banglapedia নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  4. ৪.০ ৪.১ স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  5. স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  6. গ্লাসি, হেনরি এবং মাহমুদ, ফিরোজ। ২০০৮। লিভিং ট্রাডিশন [জীবন্ত ঐতিহ্য]। কালচারাল সার্ভে অফ বাংলাদেশ সিরিজ-২। এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ। ঢাকা। পৃষ্ঠা ৫৭৮।
  7. ৭.০ ৭.১ স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  8. ৮.০ ৮.১ ৮.২ ৮.৩ ৮.৪ টেমপ্লেট:সাময়িকী উদ্ধৃতি
  9. টেমপ্লেট:বাংলাপিডিয়া উদ্ধৃতি
  10. স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  11. টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি
  12. টেমপ্লেট:সাময়িকী উদ্ধৃতি
  13. টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি
  14. ১৪.০ ১৪.১ ১৪.২ ১৪.৩ ১৪.৪ ১৪.৫ টেমপ্লেট:সাময়িকী উদ্ধৃতি
  15. মর্নিং নিউজ। ৭ ডিসেম্বর ১৯৪৭।
  16. দৈনিক আজাদ। ঢাকা: আবুল কালাম শামসুদ্দিন। ১১ ডিসেম্বর ১৯৪৮।
  17. টেমপ্লেট:Harvnb
  18. টেমপ্লেট:Harvnb
  19. দৈনিক আজাদ। ২৯ জুলাই ১৯৪৭।
  20. টেমপ্লেট:Harvnb
  21. ২১.০ ২১.১ টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি
  22. স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  23. ২৩.০ ২৩.১ ২৩.২ ২৩.৩ ২৩.৪ ২৩.৫ ২৩.৬ ২৩.৭ টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি
  24. ২৪.০ ২৪.১ ২৪.২ ২৪.৩ ২৪.৪ ২৪.৫ ২৪.৬ একুশের ইতিহাস আমাদের ইতিহাস - আহমদ রফিক পৃষ্ঠা: ৫৬, ১৪২, ৫৯
  25. টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি
  26. "বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র. পৃ-৫৪-৬৫
  27. ২৭.০ ২৭.১ ২৭.২ ২৭.৩ ২৭.৪ ২৭.৫ ২৭.৬ টেমপ্লেট:Harvnb
  28. ২৮.০ ২৮.১ স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  29. টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি
  30. আইয়ুব খান ‘প্রভু নয় বন্ধু’; পৃষ্ঠা: ৩৮
  31. টেমপ্লেট:সাময়িকী উদ্ধৃতি
  32. ৩২.০ ৩২.১ ৩২.২ টেমপ্লেট:Harvnb
  33. ৩৩.০ ৩৩.১ ৩৩.২ ৩৩.৩ টেমপ্লেট:Harvnb
  34. দৈনিক আজাদ। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮।
  35. স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  36. ৩৬.০ ৩৬.১ ৩৬.২ ৩৬.৩ ৩৬.৪ টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি
  37. টেমপ্লেট:সাময়িকী উদ্ধৃতি
  38. ৩৮.০ ৩৮.১ ৩৮.২ ৩৮.৩ টেমপ্লেট:Harvnb
  39. টেমপ্লেট:Harvnb
  40. ৪০.০ ৪০.১ ৪০.২ ৪০.৩ ৪০.৪ টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি
  41. স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  42. দৈনিক আজাদ। ২৪ মে ১৯৫০।
  43. টেমপ্লেট:Cite book
  44. ৪৪.০ ৪৪.১ ৪৪.২ ৪৪.৩ ৪৪.৪ ৪৪.৫ ৪৪.৬ টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি
  45. টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি
  46. দৈনিক আজাদ। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২।
  47. দৈনিক আজাদ, ফেব্রুয়ারি ৫, ১৯৫২
  48. পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, তৃতীয় খণ্ড, বদরউদ্দিন উমর, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ২৪৩
  49. বদরুদ্দিন ওমর, পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, তৃতীয় খন্ড, ১৯৮৪, পৃষ্ঠা নং-২৫১-২৫২
  50. পরিষদের সভায় মোট ১৫জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু মোহাম্মদ তোয়াহা ভোট দানে বিরত ছিলেন।
  51. গাজীউল হক, একুশের সংকলন, প্রকশিত: ১৯৮০, পৃষ্ঠা: ১৩৮
  52. দৈনিক আজাদ, ফেব্রুয়ারি ২২, ১৯৫২
  53. টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি
  54. দৈনিক আজাদ, ফেব্রুয়ারি ২৩, ১৯৫২
  55. স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  56. টেমপ্লেট:Harvnb
  57. টেমপ্লেট:Harvnb
  58. দৈনিক আজাদ, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
  59. টেমপ্লেট:Harvnb
  60. দৈনিক আজাদ, ২০ মার্চ ১৯৫২
  61. দৈনিক আজাদ, ১১ এপ্রিল ১৯৫২
  62. ৬২.০ ৬২.১ দৈনিক আজাদ, ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
  63. দ্য ডেইলি স্টার, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
  64. "জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫"- ওলি আহাদ পৃ-১৫৩
  65. টেমপ্লেট:Harvnb
  66. স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  67. বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এমএ/এমআই/১৮১১ ঘ.
  68. সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, ফেব্রুয়ারি ৮, ১৯৫৩
  69. সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, ১৯৫৩
  70. টেমপ্লেট:Harvnb
  71. ৭১.০ ৭১.১ ৭১.২ ৭১.৩ ৭১.৪ টেমপ্লেট:Harvnb
  72. ৭২.০ ৭২.১ টেমপ্লেট:Harvnb
  73. সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ২১, ১৯৫৩
  74. দৈনিক আজাদ, এপ্রিল ২১, ১৯৫৪
  75. দৈনিক আজাদ। ২২ এপ্রিল ১৯৫৪।
  76. ৭৬.০ ৭৬.১ ৭৬.২ স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  77. দৈনিক আজাদ, এপ্রিল ২২, ১৯৫৪
  78. স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  79. স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  80. সাপ্তাহিক নতুন খবর, ফেব্রুয়ারি ২৬, ১৯৫৬
  81. স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  82. টেমপ্লেট:সাময়িকী উদ্ধৃতি
  83. স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  84. টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি
  85. টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি
  86. টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি
  87. Court route for language status টেমপ্লেট:ওয়েব আর্কাইভ, দ্যা টেলিগ্রাফ, ২০ মে ২০০৮।
  88. স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  89. স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  90. টেমপ্লেট:সাময়িকী উদ্ধৃতি
  91. স্ক্রিপ্ট ত্রুটি: "উদ্ধৃতি" নামক কোনো মডিউল নেই।
  92. "Bangladesh History". Discovery Bangladesh. Retrieved 2007-06-21.
  93. Rahman, Tariq (September 1997). "Language and Ethnicity in Pakistan". Asian Survey 37 (9): 833–839. doi:10.1525/as.1997.37.9.01p02786. ISSN 0004-4687. JSTOR 2645700.
  94. Lintner, Bertil (January 2004). "Chapter 17: Religious Extremism and Nationalism in Bangladesh". In eds Satu Limaye, Robert Wirsing, Mohan Malik (PDF). Religious Radicalism and Security in South Asia. Honolulu, Hawaii: Asia-Pacific Center for Security Studies. p. 413. ISBN 0-9719416-6-1. Retrieved 2007-06-28. [edit]
  95. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Robert Worden 1989 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি